দেবী – হুমায়ূন আহমেদ পর্ব ২।

কী হয়েছে?” বুঝতে পারছি না।' হাসপাতালে নিতে হবে নাকি?” বুঝতে পারছি না।' ‘আপনি যান, আমি আসছি। এক্ষুণি আসছি।'
আনিস ঘরে ফিরে গেল। মনের ভুল, নিঃসন্দেহে মনের ভুল। আনিসের মনে হলাে সে ঘরের ভেতর গিয়ে দাঁড়ানােমাত্র কেউ-এক জন যেন দরজার আড়ালে সরে পড়ল। রােগা, লম্বা একটি মানুষ। আনিস ডাকল, রানু।' রানু তৎক্ষণাৎ সাড়া দিল, 'কি?'
ইলেকট্রিসিটি চলে এল তখনই। তার কিছুক্ষণের মধ্যেই রহমান সাহেব এসে উপস্থিত হলেন। উদ্বিগ্ন স্বরে বললেন, এখন কেমন অবস্থা?” রানু অবাক হয়ে বলল, “কিসের অবস্থা? কী হয়েছে?
রহমান সাহেব অবাক হয়ে তাকালেন। আনিস বলল, 'তােমার শরীর খারাপ করেছিল, তাই ওঁকে ডেকেছিলাম। এখন কেমন লাগছে?"
‘ভালাে।'
রানু উঠে বসল। রহমান সাহেবের দিকে তাকিয়ে মৃদু স্বরে বলল, 'এখন আমি ভালাে।'
রহমান সাহেব তবুও মিনিট দশেক বসলেন। আনিস বলল, 'আপনি কি ছাদে দাপাদাপি শুনেছেন?”
“সে তাে রােজই শুনি। বাদরের উৎপাত।' ‘আমিও তাই ভাবছিলাম।' ‘খুব জ্বালাতন করে। দিনে-দুপুরে ঘর থেকে খাবারদাবার নিয়ে যায়।'
তাই নাকি?” “জ্বি। নতুন এসেছেন তাের কয়েক দিন যাক, টের পাবেন। বাড়িঅলাকে বলেছিলাম গ্রিল দিতে। তা দেবে না। আপনার সঙ্গে দেখা হলে আপনিও বলবেন। সবাই মিলে চেপে ধরতে হবে।'
“জ্বি, আমি বলব। আপনি কি চা খাবেন নাকি এক কাপ?”
“আরে না না! এই রাত আড়াইটার সময় চা খাব নাকি, কী যে বলেন! উঠি ভাই। কোনাে অসুবিধা দেখলে ডাকবেন।'
ভদ্রলােক উঠে পড়লেন। রানু চাপা স্বরে বলল, 'এই রাত-দুপুরে ভদ্রলোককে ডেকে আনলে কেন? কী মনে করলেন উনি!”
“তুমি যা শুরু করেছিলে! ভয় পেয়েই লােককে ডাকলাম।'
“কী করেছিলাম আমি?”
অনেক কাণ্ড করেছ। এখন তুমি কেমন, সেটা বল। ‘ভালাে।' কী রকম ভালাে? বেশ ভালাে। ‘ভয় লাগছে না আর?”
রানু বিছানা থেকে নেমে পড়ল । সে বেশ সহজ ও স্বাভাবিক। ভয়ের কোনাে চিহ্নও নেই চোখে-মুখে। শাড়ি কোমরে জড়িয়ে ঘরের পানি সরাবার ব্যবস্থা করছে।
‘সকালে যা করবার করবে। এখন এসব রাখ তাে।' ‘ইস, কী অবস্থা হয়েছে দেখ না! ‘হােক, এস তো এদিকে।' রানু হাসি-হাসি মুখে এগিয়ে এল। এখন আর তােমার ভয় লাগছে না?”
জানালার পাশে কে যেন দাঁড়িয়েছিল বলেছিলে?" এখন কেউ নেই। আর থাকলেও কিছু যায় আসে না।'
আনিস দ্বিতীয় সিগারেটটা ধরাল। হালকা গলায় বলল, 'এক কাপ চা করতে পারবে?"
‘চা, এত রাতে!' ‘এখন আর ঘুম আসবে না, কর দেখি এক কাপ।
রানু চা বানাতে গেল। কিছুক্ষণের মধ্যেই পানি ফোটার শব্দ হলাে। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে ঝমঝম করে। রানু একা-একা রান্নাঘরে। কে বলবে এই মেয়েটিই অল্প কিছুক্ষণ আগে ভয়ে অস্থির হয়ে গিয়েছিল! ছাদে আবার ঝুপঝুপ শব্দ হচ্ছে। এই বৃষ্টির মধ্যে বানর এসেছে নাকি? আনিস উঠে গিয়ে রান্নাঘরে উকি দিল। হালকা গলায় বলল, “ছাদে বড় ধুপধাপ শব্দ হচ্ছে?' রানু জবাব দিল না।
আনিস বলল, এই বাড়িটা ছেড়ে দেব।' ‘সস্তায় এ রকম বাড়ি আর পাবে না।' দেখি পাই কি না। চায়ে চিনি হয়েছে তােমার?” হয়েছে। তুমি নিলে না?”
নাহ, রাত-দুপুরে চা খেলে আমার আর ঘুম হবে না।' রানু হাই তুলল। আনিস বলল, 'এখন বল তাে তােমার স্বপ্ন-বৃত্তান্ত।' ‘কোন স্বপ্নের কথা?" “ঐ যে স্বপ্ন দেখলে! একটা বেঁটে লােক।' ‘কখন আবার এই স্বপ্ন দেখলাম? কী যে তুমি বল!”
আনিস আর কিছু বলল না। চা শেষ করে ঘুমুতে গেল। শীত-শীত করছিল। রানু পা গুটিয়ে বাচ্চা মেয়ের মতাে শুয়েছে। একটি হাত দিয়ে জড়িয়ে রেখেছে। আনিসকে। তার ভারি নিঃশ্বাস পড়ছে। ঘুমিয়ে পড়েছে বােধহয়। জানালায় নারকেল গাছের ছায়া পড়েছে। মানুষের মতােই লাগছে ছায়াটাকে। বাতাসে গাছের পাতা নড়ছে। মনে হচ্ছে মানুষটি হাত নাড়ছে। ঘরের ভেতর মিষ্টি একটা গন্ধ। মিষ্টি, কিন্তু অচেনা।

আনিস রানুকে কাছে টেনে আনল। রানুর মুখে আলাে এসে পড়েছে। কী যে মায়াবতী লাগছে! আনিস ছােট্ট করে নিঃশ্বাস ফেলল। ওদের বিয়ে হয়েছে মাত্র ছ' মাস। আনিস এখনাে অভ্যস্ত হয়ে ওঠেনি। প্রতি রাতেই রানুর মুখ তার কাছে অচেনা লাগে। অপরূপ রূপবতী একটি বালিকার মুখ, যাকে কখনাে পুরোপুরি চেনা যায় না। আনিস ডাকল, 'রানু, রানু।' কোনাে জবাব পাওয়া গেল না। গাঢ় ঘুমে আচ্ছন্ন রানু। আনিসের ঘুম এল না। শুয়ে-শুয়ে ঠিক করে ফেলল, রানুকে ভালাে এক জন সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে নিয়ে যেতে হবে। অফিসের কমলেন্দুবাবু এক ভদ্রলােকের কথা প্রায়ই বলেন, খুব নাকি গুণী লােক। মিসির সাহেব। দেখালে হয় এক বার মিসির সাহেবকে।
রানু ঘুমের ঘােরে খিলখিল করে হেসে উঠল। অপ্রকৃতিস্থ মানুষের হাসি। শুনতে ভালাে লাগে না, গা ছমছম করে।
ভদ্রলােকের বাড়ি খুঁজে বের করতে অনেক দেরি হলাে। কাঠালবাগানের এক গলির ভেতর পুরােনাে ধাচের বাড়ি। অনেকক্ষণ কড়া নাড়বার পর অসম্ভব রােগা এক ভদ্রলােক বেরিয়ে এলেন। বিরক্ত মুখে বললেন, 'কাকে চান?” “মিসির সাহেবকে খুঁজছি।' তাকে কী জন্যে দরকার?" “জ্বি, আছে একটা দরকার। আপনি কি মিসির সাহেব?”
হা। বলেন, দরকারটা বলেন। রাস্তায় দাঁড়িয়ে সমস্যার কথা বলতে হবে নাকি? আনিস অস্বস্তি বোধ করতেলাগল।
 কিন্তু ভদ্রলােকের ভাবভঙ্গি এ রকম যে, বাইরেই দাঁড় করিয়ে রাখবেন, ভেতরে ঢুকতে দেবেন না। আনিস বলল, “ভেতরে এসে বলি?” | ‘ভেতরে আসবেন? ঠিক আছে, আসুন।'
মিসির সাহেব যেন নিতান্ত অনিচ্ছায় দরজা থেকে সরে দাঁড়ালেন। ঘন অন্ধকার। তিন-চারটা বেতের চেয়ার ছাড়া আসবাবপত্র কিছু নেই।
বসুন আপনি।
আনিস বসল। দ্রলােক বললেন, “আজ আমার শরীর ভালাে না। আলসার আছে। ব্যথা হচ্ছে এখন। তাড়াতাড়ি বলেন কি বলবেন।'
‘আমার স্ত্রীর একটা ব্যাপারে আপনার কাছে এসেছি। আপনার নাম শুনেই এসেছি।'
‘আমার নাম শুনে এসেছেন?' “জ্বি।'
‘আমার এত নামডাক আছে, তা তাে জানতাম না! স্পেসিফিক্যালি বলুন তাে কার কাছে শুনেছেন?
আনিস আমিতা-আমতা করতে লাগল। ভদ্রলােক অসহিষ্ণু স্বরে বললেন, বলুন, কে বলল?”
‘আমাদের অফিসের এক ভদ্রলােক। কমলেন্দুবাবু। আপনি নাকি তাঁর বােনের চিকিৎসা করেছিলেন।
“ও আচ্ছা, চিনেছি, কমলেন্দু। শােনেন, আমি কিন্তু ডাক্তার না, জানেন তাে?” “জ্বি স্যার, জানি।
আচ্ছা, আগে এক কাপ চা খান, তারপর কথা বলব। রুগীটি কে বললেন? আপনার স্ত্রী?
‘বয়স কত? ‘ষােল-সতের। বলেন কী! আপনার বয়স তাে মনে হয় চল্লিশের মতাে, ঠিক না?” আনিস শুকনাে গলায় বলল, “আমার সাঁইত্রিশ।' “এ রকম অল্পবয়সী মেয়ে বিয়ে করেছেন কেন?
এটা আবার কেমন প্রশ্ন। আনিসের মনে হলাে, কমলেন্দুবাবুর কথা শুনে এখানে আসাটা ঠিক হয় নি। ভদ্রলােকের নিজেরই মনে হয় মাথার ঠিক নেই। এক জন অপরিচিত মানুষকে কেউ এ রকম কথা জিজ্ঞেস করে?
'বলুন বলুন, এ রকম অল্পবয়েসী মেয়ে বিয়ে করলেন কেন?”


হয়ে গেছে আর কি। 'বলতে চান না বােঝা যাচ্ছে। ঠিক আছে, বলতে হবে না। চা'র কথা বলে আসি। চা খেয়ে তারপর শুরু করব।'
দ্রলােক আনিসকে বাইরে বসিয়ে ভেতরে চলে গেলেন। তারপর আর আসার নামগন্ধ নেই। আট-ন' বছরের একটি বাচ্চা মেয়ে এক কাপ দারুণ মিষ্টি সর-ভাষা চা দিয়ে চলে গেল। তারপর আর কোনাে সাড়াশব্দ নেই। দেখতেদেখতে সন্ধ্যা হয়ে যায়। আনিস বেশ কয়েক বার কাশল। দুই বার গলা উচিয়ে ডাকল, বাসায় কেউ আছেন?' কোনাে সাড়া নেই। কী ঝামেলা!
কমলেন্দুৰাৰু অবশ্য বারবার বলে দিয়েছেন—এই লােকের কথাবার্তার ঠিকঠিকানা নেই। তবে লােকটা অসাধারণ। আনিসের কাছে অসাধারণ কিছু মনে হয় নি। তবে চোখের দৃষ্টি খুব তীক্ষ। এইটি অবশ্য প্রথমেই চোখে পড়ে। আর দ্বিতীয় যে জিনিসটি চোখে পড়ে, সেটি হচ্ছে তার আঙুল। অস্বাভাবিক লম্বা-লম্বা সব কটা আঙুল।।
‘এই যে, অনেকক্ষণ বসিয়ে রাখলাম।' ‘না, ঠিক আছে।' “ঠিক থাকবে কেন? ঠিক না।'
লােকটি এই প্রথম বার হাসল। থেমে-থেমে বলল, “আলসার আছে তাে, ব্যথায় কাহিল হয়ে শুয়েছিলাম। অমনি ঘুম এসে গেল।
‘আমি তাহলে অন্য এক দিন আসি?" না, এসেছেন যখন বসুন। চা দিয়েছিল?'
“বেশ, এখন বলুন কী বলবেন?
আনিস চুপ করে রইল। এটা এমন একটা ব্যাপার, যা চট করে অপরিচিত কাউকে বলা যায় না। ভদ্রলােক শান্ত স্বরে বললেন, 'আপনার স্ত্রীর মাথার ঠিক নেই, তাই তাে?"
“জি-না স্যার, মাথা ঠিক আছে।' ‘পাগল নন?" “জ্বি-না।' তাহলে আমার কাছে এসেছেন কেন?” মাঝে-মাঝে সে অস্বাভাবিক আচরণ করে। কী রকম অস্বাভাবিক?'
ভয় পায়? তার মানে কী? কিসের ভয়?" ভূতের ভয়। ‘ঠিক জানেন, ভয়টা ভূতের? “জ্বি-না, ঠিক জানি না। মনে হয় এ রকম।'
ভদ্রলােক একটি চুরুট ধরিয়ে খকখক করে কাশতে-কাশতে বললেন, 'বর্মা থেকে আমার এক বন্ধু এনেছে, অতি বাজে জিনিস।' আনিস কিছু বলল না। তবে এই ভদ্রলােকের স্টাইলটি তার পছন্দ হলাে। ভদ্রলােক অবলীলায় অন্য একটি প্রসঙ্গ নিয়ে এসেছেন। এবং এমনভাবে কথা বলছেন, যেন আগের কথাবার্তা তার কিছুই মনে নেই।
“এ রকম চুরুট চার-পাঁচটা খেলে যক্ষ্মা হয়ে যাবে। আপনাকে দেব একটা?” “জ্বি-না।'
‘ফেলে দিলে মায়া লাগে বলে খাই। খাওয়ার জিনিস না। অখাদ্য। তবে হাভানা চুরুটগুলি ভালাে। হাভানা চুরুট খেয়েছেন কখনাে?”
“জি-না।' ‘খুব ভালাে। মাঝে-মাঝে আমার এক বন্ধু আমাকে দিয়ে যায়।'
ভদ্রলােক চুরুটে টান দিয়ে আবার ঘর কাঁপিয়ে কাশতে লাগলেন। কাশি থামতেই বললেন, এখন আমি আপনাকে কয়েকটা প্রশ্ন করব। যথাযথ জবাব দেবেন।'
‘জি আচ্ছা। ‘প্রথম প্রশ্ন, আপনার স্ত্রী কি সুন্দরী?”
‘বেশ সুন্দরী?”
আপনার স্ত্রী কখন ভয় পান—রাতে না দিনে?” ‘সাধারণত রাতে। তবে এক বার দুপুরে ভয় পেয়েছিল। ভয়টা কী রকম সেটা বলেন। মনে হয় কিছু-একটা দেখে।' সব বার একই জিনিস দেখেন, না একেক বার একেক রকম?" ‘এটা আমি ঠিক বলতে পারছি না।' ‘এই সময় কি তিনি কোনাে রকম গন্ধ পান?” ‘আমি ঠিক বলতে পারছি না।' ‘যখন সুস্থ হয়ে ওঠেন, তখন কি তাঁর ভয়ের কথা মনে থাকে?
বেশির ভাগ সময়ই থাকে না, তবে মাঝে-মাঝে থাকে।' আপনার স্ত্রীর স্বাস্থ্য নিশ্চয়ই খারাপ। “জ্বি।' উনি প্রথম কখন ভয় পেয়েছিলেন, বলতে পারেন? “জ্বি-না। তবে খুব ছােটবেলায়।' ‘প্রথম ভয়ের ঘটনাটা আমাকে বলুন। ‘আমি সেটা ঠিক জানি না।'
"আপনি অনেক কিছুই জানেন না মনে হচ্ছে। আপনার স্ত্রীকে একদিন নিয়ে আসুন।
আনিস কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, 'আমি তাকে আনতে চাই না।' কেন চান না?”
সে খুব সেনসিটিভ। সে যদি টের পায় যে, তার এই অস্বাভাবিকতা নিয়ে আমি লােকজনের সাথে আলাপ করছি, তাহলে খুব মন-খারাপ করবে।'
দেখুন ভাই, আপনার স্ত্রীর সঙ্গে কথা না-বলে কিছুই করা যাবে না। আপনার স্ত্রী অসুস্থ এবং আমার মনে হচ্ছে এই অসুখ দ্রুত বেড়ে যাবে। আপনি তাঁকে নিয়ে আসবেন।
আনিস উঠে দাঁড়াল। ক্ষীণ স্বরে বলল, “আপনাকে কত দেব?”
ভদ্রলােক বিস্মিত হয়ে বললেন, 'কমলেন্দুবাবু কি আপনাকে বলেন নি আমি ফিস নিই না? এই কাজটি আমি শখের খাতিরে করি, বুঝতে পারছেন?'
“জ্বি পরছি।'
তবে আপনি যদি ভালাে গােলাপের চারা পান, তাহলে আমাকে দিতে পারেন। আমার গােলাপের খুব শখ। সব মিলিয়ে ত্রিশটি ডিফারেন্ট ভেরাইটির চারা আমার কাছে আছে। একটা আছে দারুণ ইন্টারেস্টিং, ঘাসফুলের মতাে ছােট সাইজের গোলাপ।'
“তাই নাকি?" “জ্বি। ওরা বলে মাইক্রো রােজ। হল্যাণ্ডের গােলাপ। কড়া গন্ধ। দেখবেন?' ‘আরেক দিন দেখব। আজ দেরি হয়ে গেছে, আমার মা একা থাকে।'
ও, তাই নাকি? শশানেন, একা তাকে রাখবেন না। কখনাে যেন মেয়েটি একা না থাকে। এটা খুবই জরুরি।'
রাস্তায় নেমে আনিসের মন খারাপ হয়ে গেল। খামােকা সময় নষ্ট। লােকটি তেমন কিছু জানে না। কমলেন্দুবাবু যে সব আধ্যাত্মিক শক্তিটক্তির কথা বলেছেন, সে সব মনে হয় নেহায়েতই গালগল্প। তবে লোকটির কথাবার্তা বেশ ফোর্সফুল।
রানুকে বুঝিয়েসুঝিয়ে এক বার এনে দেখালে হয়। ক্ষতি তাে কিছু নেই।
তা ছাড়া ভদ্রলােক খুব সম্ভব ফ্যালনাও নন। ক্লিনিক্যাল সাইকিয়াট্রির টীচার। একেবারে কিছু না-জেনে তাে কেউ মাষ্টারি করে না। কিছু নিশ্চয়ই জানেন। মানুষের চেহারা দেখে কিছু অনুমান করাটাও ঠিক না।

আনিস অফিসে চলে গেলে রানুর খুব একলা লাগে। কিছুই করার থাকে না। গােছানাে আলনা আবার নতুন করে গােছায় । বসার ঘরের বেতের সােফা ঝাড়ন। দিয়ে ঝাড়ে। শােবার মেঝে ভেজা ন্যাকড়া দিয়ে মুছতে মুছতে চকচকে করে। ফেলে, তবু সময় কাটে না। এক সময় তেতলার বারান্দায় গিয়ে বসে। এ-বাড়ির ছােট বারান্দাটি তার খুব পছন্দ। গ্রিল দেওয়া বারান্দাটি গোলাকার। এখানে বসে। অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যায়। সামনেই একটা মেয়েদের স্কুল। টিফিন টাইমে। মেয়েগুলাের কাণ্ডকারখানা দেখতে এমন মজা লাগে! রানু প্রায় সারা দুপুর বারান্দাতেই বসে থাকে। একা-একা ঘরে বসে থাকতে ভালাে লাগে না। কেমন। যেন নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। একটু যেন ভয়ভয়ও লাগে। | অবশ্য যখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল নামতে থাকে, তখন ভয়ভয় ভাবটা কমে। যায়। বিকেলবেলা বাড়িঅলার মেয়ে দুটি তাদের ভেতরের দিকের বাগানে বসে মজা করে চা খায়। চা খেতে-খেতে দুইজনেই খুব হাসাহাসি করে। একেক দিন ওদের বাবাও সঙ্গে বসেন, রানুর দেখতে বেশ লাগে।
| ছােট মেয়েটির সঙ্গে রানুর কিছু দিন আগে আলাপ হয়েছিল। বেশ মেয়েটি! খুব স্মার্ট। দেখতেও সুন্দর। এক দিন দুপুরে রানু বারান্দায় এসে বসেছে, মেয়েটি এসে উপস্থিত। মুখে চাপা হাসি। হাতে কী-একটা বই। এসেই বলল, 'আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করতে এসেছি।'
“কি কথা? ‘আপনি সারা দিন বারান্দায় বসে থাকেন কেন?”
সারা দিন কোথায়? দুপুরবেলায় বসি। কিছু করার নেই তাে, একা-একা লাগে।
‘তা ঠিক। বসব আপনার এখানে? আজ আমি কলেজে যাই নি। বােটানি প্র্যাকটিক্যাল ছিল আজকে।
মেয়েটি খুব সহজভাবে বসল। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে একগাদা কথা বলল। তারপর যাবার সময় হঠাৎ বলল, 'আরেকটা কথা জিজ্ঞেস করব?'
কর।'
| ‘আপনি এত সুন্দর কেন? যে আমার চেয়েও সুন্দরী, তাকে আমার ভালাে। লাগে না।'
রানু কী বলবে ভেবে পেল না। মেয়েটি হাসতে হাসতে বলল, 'আমাদের ক্লাসের মেয়েদের কি ধারণা, জানেন? তাদের ধারণা, আমি হচ্ছি বাংলাদেশের সবচেয়ে সুন্দরী মহিলা। ওদের এক দিন এনে আপনাকে দেখিয়ে দেব।”
“ঠিক আছে, দিও। আরেকটু বস। চা খাবে?" না, চা আমি বেশি খাই না। বেশি চা খেলে গায়ের রঙ ময়লা হয়ে যায়।'
মেয়েটি যেমন হুট করে এসেছিল, তেমনি হুট করে নিচে নেমে গেল। বেশ লাগল রানুর। নতুন বাসাটা তার ভালােই লাগছে। পুরােনাে ঢাকায় হলেও বেশ নিরিবিলি। মালিবাগের বাসাটার মতাে নয়। নিঃশ্বাস নেবার জায়গা ছিল না। সেখানে। পাশ দিয়ে রাত-দিন রিকশা যাচ্ছে, গাড়ি যাচ্ছে। জঘন্য! এই বাসাটা ভেতরের দিকে। বাড়িঅলা লােকও বেশ ভালােমানুষ। প্রথম দিনেই আনিসকে বলেছেন, 'আমার বাড়ি ভাড়া দেবার দরকার নেই। টাকার জন্যেই তাে বাড়ি ভাড়া। টাকা যথেষ্ট আছে। তবু দুই ঘর ভাড়াটে রাখি। কারণ এত বড় বাড়িতে। মানুষ না-থাকলে ভালাে লাগে না। কবরখানা-কবরখানা ভাব চলে আসে। তবে সবাইকে আমি বাড়ি ভাড়া দিই না। আপনাকে দিচ্ছি, কারণ আপনাকে পছন্দ হয়েছে।'
ভাড়াও খুব কম। মাত্র ছয় শ' টাকা। তিন-রুমের এত বড় একটা বাড়ি হয় শ' টাকায় পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। রানু এখানে এসে হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছে। তার। সবচেয়ে পছন্দ হয়েছে বাথরুম। বড় ঝকঝকে একটা বাথরুম। বাসাটা রানুর খুব পছন্দ হয়েছিল। আনিস যখন বলল, “কি, নেব? পছন্দ হয়?”
ভালাে করে ভেবে বল নেব কি না। দুই দিন পর যদি বল পছন্দ না, তাহলে মুশকিলে পড়ব। মালিবাগের বাসাটা ভালাে ছিল। শুধু-শুধু বদলালাম।'
“এই বাসাটাও ভালাে।'
রানু খুব খুশি মনে নতুন বাসা সাজাল। নিজেই পরদা কিনে আনল, সারা রাত জেগে সেলাই করল। তার উৎসাহের সীমা নেই।
'বুঝলে রানু, সবার সঙ্গে মিলেমিশে থাকবে। অন্যদের বাসায় যাবে-টাৰে। একা-একা থাকার অভ্যেসটা ভালাে না। যাবে তাে?'
যাব।'
‘একা থাকলেই মানুষের মধ্যে নানান রকম প্রবলেম দেখা যায়, বুঝলে? সব ভাড়াটেদের সঙ্গে খাতির রাখবে।'
কী হয়েছে?” বুঝতে পারছি না।' হাসপাতালে নিতে হবে নাকি?” বুঝতে পারছি না।' ‘আপনি যান, আমি আসছি। এক্ষুণি আসছি।'
আনিস ঘরে ফিরে গেল। মনের ভুল, নিঃসন্দেহে মনের ভুল। আনিসের মনে। হলাে সে ঘরের ভেতর গিয়ে দাঁড়ানােমাত্র কেউ-এক জন যেন দরজার আড়ালে সরে পড়ল। রােগা, লম্বা একটি মানুষ। আনিস ডাকল, রানু।' রানু তৎক্ষণাৎ সাড়া দিল, "কি?" | ইলেকট্রিসিটি চলে এল তখনই । তার কিছুক্ষণের মধ্যেই রহমান সাহেব এসে উপস্থিত হলেন। উদ্বিগ্ন স্বরে বললেন, এখন কেমন অবস্থা?” রানু অবাক হয়ে বলল, 'কিসের অবস্থা? কী হয়েছে?'
রহমান সাহেব অবাক হয়ে তাকালেন। আনিস বলল, 'তােমার শরীর খারাপ করেছিল, তাই ওঁকে ডেকেছিলাম। এখন কেমন লাগছে?"
‘ভালাে।'
রানু উঠে বসল। রহমান সাহেবের দিকে তাকিয়ে মৃদু স্বরে বলল, 'এখন আমি ভালাে।'
রহমান সাহেব তবুও মিনিট দশেক বসলেন। আনিস বলল, 'আপনি কি ছাদে দাপাদাপি শুনেছেন?”
“সে তাে রােজই শুনি। বাদরের উৎপাত।' ‘আমিও তাই ভাবছিলাম।' ‘খুব জ্বালাতন করে। দিনে-দুপুরে ঘর থেকে খাবারদাবার নিয়ে যায়।' “তাই নাকি?”
“জ্বি। নতুন এসেছেন তাে! কয়েক দিন যাক, টের পাবেন। বাড়িঅলাকে। বলেছিলাম গ্রিল দিতে। তা দেবে না। আপনার সঙ্গে দেখা হলে আপনিও বলবেন। সবাই মিলে চেপে ধরতে হবে।'
‘জ্বি, আমি বলব। আপনি কি চা খাবেন নাকি এক কাপ?”
“আরে না না! এই রাত আড়াইটার সময় চা খাব নাকি, কী যে বলেন! উঠি ভাই। কোনাে অসুবিধা দেখলে ডাকবেন।'
দ্রলােক উঠে পড়লেন। রানু চাপা স্বরে বলল, “এই রাত-দুপুরে লোককে ডেকে আনলে কেন? কী মনে করলেন উনি!”
‘তুমি যা শুরু করেছিলে! ভয় পেয়েই লােককে ডাকলাম।'
চলবে ........................
Share This

0 Response to "দেবী – হুমায়ূন আহমেদ পর্ব ২।"

Post a Comment

AD