কুরআন ও হাদিসের আলোকে ‘পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী’

ঈদে মিলাদুন্নবী’ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুসলিম বিশ্বের ঈমানি প্রেরনার জয় ধ্বনী নিয়ে প্রতি বছর আমাদের মাঝে আসে রবিউল আওয়াল মাসে। পবিত্র ‘ঈদে মিলাদুন্নবী’ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পালন করা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের অন্যতম উৎসব। যুগে যুগে বাতিলদের শনাক্ত করার কিছু নিদর্শন ছিল। তেমনিভাবে তারই ধারাবাহিকতায় বর্তমান সমাজে ও বাতিলদের চিনার নিদর্শন হল পবিত্র ‘ঈদে মিলাদুন্নবী’ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বিরোধিতা করা। বাতিলদের বেড়াজাল থেকে মুসলিম মিল্লাতকে সচেতন করার উদ্দেশ্যে আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস। পবিত্র ‘ঈদে মিলাদুন্নবী’ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কি? ঈদ শব্দের আভিধানিক অর্থ হল খুশী হওয়া, ফিরে আসা, আনন্দ উৎযাপন করা ইত্যাদি। আর মিলাদুন্নবী’ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলতে আমরা নবীজীর আগমনকে বুঝায়। আর ‘ঈদে মিলাদুন্নবী’ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলতে নবীজীর আগমনে খুশী উৎযাপন করাকে বুঝায়। সুতরাং অশান্তি আর বর্বরতায় ভরপুর সংঘাতময় আরবের বুকে আধারের বুক চিড়ে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শান্তি নিয়ে এসে মানবজাতিকে সত্যের, সভ্যতা ও ন্যায়ের দিক নির্দেশনা দিয়ে গোটা বিশ্বকে শান্তিতে পরিপূর্ণ করে তুলেন। নবীজীর পবিত্র শুভাগমনে খুশী উৎযাপন করাটাই হচ্ছে ‘ঈদে মিলাদুন্নবী’ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। কুরআনুল কারীমের দৃষ্টিতে পবিত্র ‘ঈদে মিলাদুন্নবী’ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম : আল্লাহ পাক রাব্বুল আলামীন বলেন- অর্থাৎ- আল্লাহ বলেন, হে প্রিয় রাসূল! আপনি স্মরণ করুন ঐ দিনের ঘটনা”- (রোজে আজলের সময়ের) যখন আমি (আল্লাহ) আম্বিয়ায়ে কেরামগণের নিকট থেকে এইভাবে অঙ্গীকার নিয়েছিলাম যে, যখন ‘আমি তোমাদেরকে কিতাব এবং হিকমত’ অর্থাৎ নবুয়ত দান করবো, অতঃপর তোমাদের কাছে এক মহান রাসূলের শুভাগমন হবে- যিনি তোমাদের প্রত্যেকের নবুয়তের সত্যায়ন করবেন, তখন তোমরা সকলে অবশ্যই তাঁর উপর ঈমান আনযন করবে এবং সর্বোত্তমভাবে তাঁকে সাহায্য সহযোগিতা করবে। তোমরা কি এ কথার অঙ্গীকার করছো এবং অঙ্গীকারে কি অটল থাকবে? সমস্ত নবীগণ বললেন- হাঁ, আমরা অঙ্গীকার করলাম। আল্লাহ তায়ালা বললেন- তোমরা পরস্পর স্বাক্ষী থেকো এবং আমি ও তোমাদের সাথে স্বাক্ষী রইলাম। এর পরেও যে কেউ পিছপা হয়ে যাবে- তারা হবে ফাসেক। সূত্রঃ তৃতীয় পারা, সূরা আল-ইমরান ৮১-৮২ নং আয়াত। এখানে লক্ষ্য করার বিষয় হলো (১) আয়াতের ইবারাতুন নস-এর দ্বারা প্রমাণিত হলো যে, অন্যান্য নবীগণ থেকে আল্লাহ তায়ালা অঙ্গীকার আদায় করেছিলেন। (২) দালালাতুন নস- এর দ্বারা প্রমাণিত হলো যে, সমস্ত নবীগণ সেদিন মাহফিলে উপস্থিত ছিলেন। (৩) ইশারাতুন নস- এর দ্বারা প্রমাণিত হলো যে, মূলত ঐ মাহফিলটি নবীজীর আগমনী বা মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম- এর মাহফিল ছিল। (৪) ইক্বতেজাউন নস- এর দ্বারা প্রমাণিত হলো যে, ঐ সময় সমস্ত নবীগণ কি্বয়াম অবস্থায় ছিলেন। কারণ ঐ দরবারে বসার কোন অবকাশ নেই এবং পরিবেশটিও ছিল আদবের। আরো লক্ষ্য করার বিষয় হচ্ছে- এই আয়াতে আল্লাহ পাক রাব্বুল আলামীন ‘মিলাদুন্নবী’ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অর্থাৎ নবীজীর আগমন সম্পর্কে রোজ আজলের মধ্যে সমস্ত নবীগণকে উপস্থিত রেখে আলোচনা করেছেন। নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এমন প্রিয় আল্লাহর রাসূল, তাঁর সাথে মানুষের তুলনা হবেতো দূরের কথা, অন্য কোনো নবীর ও তুলনা হয়না। এজন্যই আল্লাহ তায়ালা সমস্ত নবীদের নিকট দুটি হুশিয়ারী বাণী প্রদান করেছেন। যথা- (১) আমার বন্ধুর উপর ঈমান আনতে হবে। (২) আমার বন্ধুকে সর্বোত্তমভাবে সাহায্য সহযোগিতা করতে হবে। মানুষ যখন কোনো নেয়ামত ও রহমত প্রাপ্ত হয় তখন তার জন্য আনন্দ উৎসব করা তার স্বভাবগত কাজ, আর আল্লাহর নির্দেশও তাই। যেমন- পবিত্র কোরআনে এরশাদ করেন- অর্থাৎ- হে মানবকুল তোমাদের নিকট তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে উপদেশ এসেছে এবং অন্তর সমূহের বিশুদ্ধতা, হেদায়াত এবং রহমত ঈমানদারদের জন্য। হে হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আপনি বলুন! আল্লাহরই অনুগ্রহ ও তাঁর দয়া প্রাপ্তিতে তারা যেন আনন্দ প্রকাশ করে। এটা তাদের সমস্ত ধন দৌলত সঞ্চয় করা অপেক্ষা শ্রেয়। (সূরা ইউনুছ, আয়াত নং- ৫৭-৫৮)। এই আয়াতের ব্যাখ্যায় ইমাম জালাল উদ্দিন সুয়ূতী (রহঃ) তাঁর তাফসীর গ্রন্থ আদ দুররুল মুনছুর এ উল্লেখ করেন- অর্থাৎ- হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) এ আয়াতের তাফসীরে বলেন এখানে আল্লাহর অনুগ্রহ (ফাদ্বলুল্লাহ) দ্বারা ইলমে দ্বীন বুঝানো হয়েছে আর (রহমত) দ্বারা সরকারে দু’আলম নূরে মোজাচ্ছম আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বুঝানো হয়েছে। যেমন- আল্লাহ তায়ালা বলেন, (ওয়ামা আরসালনাকা ইল্লা রাহমাতালি্লল আলামীন) অর্থাৎ হে হাবীব আমি আপনাকে সমগ্র বিশ্বের জন্য রহমত করেই প্রেরণ করেছি। সূত্রঃ সূরা আম্বিয়া আয়াত নং- ১০৭, তাফসীরে রুহুল মায়ানী, তাফসীরে কবির ও ইমাম সূয়ূতী (রহঃ) কৃত তাফসীরই আদ দুররুল মুনছুর, ৪র্থ খন্ড- ৩৬ পৃষ্ঠায় ও অনুরূপ বর্ণনা করেছেন। সামান্য জাগতিক নিয়ামত লাভ করলে তজ্জন্য ঈদ উৎসব করার সরাসরি উদাহরণ আমরা পবিত্র কুরআন মাজীদে দেখতে পাই। যেমন- অর্থাৎ- মরিয়ম তনয ঈসা (আঃ) আরয করলেন, হে আল্লাহ! হে আমাদের রব, আমাদের উপর আকাশ থেকে একটা খাদ্য খাঞ্চা অবতরণ করুন যা আমাদের ও আমাদের পূর্ববর্তী সকলের জন্য ঈদ হবে এবং আপনারই নিদর্শন হবে, সুতরাং আমাদেরকে রিযিক দান করুন। আর আপনিইতো হলেন সর্বশ্রেষ্ঠ রিযিক দাতা। (সূরা মায়েদা, আয়াত নং- ১১৪)। এ আয়াত থেকে প্রতীয়মান হয় যে, আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে খাঞ্চাভরা খাদ্য আসলে তা যদি হযরত ঈসা (আঃ)-এর ভাষায় পূর্ব ও পরবর্তী সকলের জন্য আনন্দ, উৎসবের কারণ ও আল্লাহর নিদর্শন হয়, তাহলে সৃষ্টির মধ্যে সর্বোত্তম সত্ত্বা, রহমতের ভান্ডার, প্রিয় নবী আকাও মাওলা হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামার মত মহান নিয়ামতের শুভাগমনের দিন কতইনা মর্যাদাবান, গুরুত্বপূর্ণও আনন্দের দিন বা মাস তা বলার অপেক্ষা রাখেনা। খোলাফায়ে রাশেদীনের আমলে পবিত্র ‘ঈদে মিলাদুন্নবী’ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিল কি-না? আল্লামা শাহাবুদ্দীন ইবনে হাজর হায়তামী (রহঃ) বলেন, খোলাফায়ে রাশেদীনের যুগেও ‘ঈদে মিলাদুন্নবী’ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পালন করার নীতি প্রচলন ছিল। যেমন- অর্থাৎ- হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রাঃ) বলেছেন- “যে ব্যক্তি ‘মিলাদুন্নবী’ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পাঠ করার জন্য এক দিরহাম অর্থ খরচ করবে, সে ব্যক্তি বেহেশ্তে আমার সাথী হবে”। হযরত ওমর ফারুক (রাঃ) বলেছেন- “যে ব্যক্তি ‘মিলাদুন্নবী’ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে তাজীম ও সম্মান করলো, সে যেন ইসলামকেই জীবিত রাখলো”। হযরত ওসমান (রাঃ) বলেছেন- “যে ব্যক্তি ‘মিলাদুন্নবী’ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পাঠ করার জন্য এক দিরহাম অর্থ খরচ করলো, সে যেন বদর ও হোনাইনের যুদ্ধে শরীক হলো”। হযরত আলী (রাঃ) বলেছেন- “যে ব্যক্তি ‘মিলাদুন্নবী’ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সম্মান করবে এবং মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পাঠ করার উদ্যোক্তা হবে, সে দুনিয়া থেকে (তওবার মাধ্যমে) ঈমানের সাথে বিদায় হবে এবং বিনা হিসাবে জান্নাতে প্রবেশ করবে”। সূত্রঃ আন নে’মাতুল কোবরা আলাল ফি মাওলিদি সাইয়্যেদ ওলদে আদম ৭-৮ পৃষ্ঠা। পবিত্র ‘ঈদে মিলাদুন্নবী’ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পালন করার উপকারিতা : ‘ঈদে মিলাদুন্নবী’ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামার উপকারিতা সম্পর্কে বুঝার জন্য উপরোক্ত হাদীসই যথেষ্ট। এর জন্য সামান্য পরিমাণ অর্থ ব্যয় করলে অনেক উপকারিতা রয়েছে। যেমন- বেহেস্তে হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রাঃ)-এর সাথী হওয়া, ইসলামকে জীবিত রাখা, বদর ও হোনাইনের মত গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধে কাফেরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার সমতুল্য নেকী অর্জন করা এবং পৃথিবী থেকে ঈমানের সাথে বিদায়ের নিশ্চয়তা ও বিনা হিসাবে বেহেস্তে প্রবেশ করার মত সৌভাগ্য লাভ হয় এই ‘মিলাদুন্নবীর মাহফিলে’। খোলফায়ে রাশেদীনের অভিমত ও আমল আমাদের জন্য একটি শক্ত দলীল। ‘ঈদে মিলাদুন্নবী’ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উপকারিতা সম্পর্কে জুরকানী শরীফে রয়েছে, যা আবু লাহাব সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে। যেমন- অর্থাৎ- হযরত ছুয়ায়লি (রাঃ) বর্ণনা করেছেন, হযরত আব্বাস (রাঃ) এরশাদ করেন যে, যখন আবু লাহাব মারা যায় তার এক বছর পর আমি তাকে স্বপ্নে দেখি যে, সে বড়ই খারাপ অবস্থায় আছে এবং সে বলছিল, তোমাদের কাছ থেকে আসার পর আমার কোনো শান্তি নসীব হয়নি। হঁ্যা এতটুকু অবশ্যই যে, প্রত্যেক সোমবার আমার আযাব হালকা করে দেয়া হয়। তা শুনে হযরত আব্বাস (রাঃ) বললেন, এটি এ জন্যই যে, নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সোমবার দিন দুনিয়াতে তাশরীফ এনেছেন। আর ছোয়াইবা নামী জনৈকা ক্রীতদাসী তাকে নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামার আগমনের শুভ সংবাদ দিয়েছিল বিধায় সন্তুষ্টি চিত্তে আবু লাহাব তাকে আজাদ করে দিয়েছিল। সূত্রঃ (ফাতহুল বারি ৯ম খন্ড ১১৮ পৃষ্ঠা, জুরকানী শরীফ ১ম খন্ড ২৬০ পৃষ্ঠা) হাদীসখানা আল্লামা বদরুদ্দিন আঈনি ও তার ওমদাতুল কারী শরহে ছহীহ বুখারীতে ২য় খন্ডের ২৯৯ পৃষ্ঠায় বর্ণনা করেছেন।
Share This

0 Response to "কুরআন ও হাদিসের আলোকে ‘পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী’"

Post a Comment

AD