সূত্র জানায়, হেফজ বিভাগের শিশুটিকে দেখতে গতকাল বিকেলে তার বাবা-মা মাদ্রাসায় আসেন। তাঁরা চলে যাওয়ার পরপরই শিশুটি মাদ্রাসা থেকে বাইরে বের হয়। তখন শিশুটিকে ধরে মাদ্রাসার ভেতরে নিয়ে মারধর করেন শিক্ষক ইয়াহিয়া।
৩৩ সেকেন্ডের ভিডিওতে দেখা যায়, শিক্ষক ইয়াহিয়া শিশুটিকে ঘাড় ধরে মাদ্রাসার ভেতরে নিয়ে যান। পরে তিনি শিশুটিকে বেধড়ক পেটান।
এই ঘটনার নিন্দা জানিয়ে সময়ের সবচেয়ে আলোচিত ইসলামিক বক্তা মিজানুর রহমান আজহারি তার ফেইসবুকে একটি স্ট্যাটাস দিয়েছেন যেখানে তিনি মাদ্রাসার শিশু নির্যাতন বন্ধে সকলকে এগিয়ে আসার অনুরোধ জানান। নিচে তার ফেইসবুক স্ট্যাটাস তুলে ধরা হলো।
“॥ জোর করে কিছু শেখানোর নাম শিক্ষা নয়, শিক্ষা হল আপনার সন্তানের সত:স্ফুর্ত আত্মবিকাশ ॥
হিফজখানাগুলোতে শিশু নির্যাতনের ইতিহাস এদেশে অনেক পুরাতন। আধুনিককালে প্রায়শই নির্যাতনের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেখা যায়। সম্প্রতি যে ভিডিওটি ভাইরাল হয়েছে সেটা দেখে রীতিমত সবাই আতকে উঠেছে। চোর ডাকাতকেও তো মানুষ এভাবে পেটায় না। আমার প্রশ্ন হচ্ছে এই নির্দয় শিক্ষক কি কোন ভুল করলে তার নিজ সন্তানকেও বাসায় এভাবেই পেটায়? একজন হাফেজে কুরআন শিক্ষক কিভাবে এতটা হিংস্র, আর অমানবিক হতে পারে?
.
কুরআনকে শুধু হিফজ করে বুকে ধারণ করলেই আলোকিত মানুষ হওয়া যায় না। কুরআনের প্রকৃত মর্মার্থ অনুধাবন করতে হয়, কুরআনের রঙ্গে রংঙ্গীন হতে হয় এবং কুরআনের অমিয় শিক্ষাকে হৃদয়ে ধারণ করতে জানতে হয়, তাহলেই একজন মানুষ আলোকিত মানুষ হয়ে উঠে। আসলে এরা সুযোগের অভাবে সৎ। বড় কোন দায়িত্ব পেলে নিশ্চিত এরা সেখানেও এরকম হিংস্র তান্ডব চালাতো। তাই, সময় এসেছে ধর্মীয় শিক্ষার নামে এসব অমানবিক নির্যাতনের বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলার। নিজ নিজ এলাকার হিফজখানাগুলোর খোঁজ নিন। নির্যাতনের অভিযোগ পেলে স্থানীয় প্রশাসনকে জানান। এদেরকে বিচারের আওতায় আনুন।
.
প্রতিটি হাফিজিয়া মাদ্রাসায় বাধ্যতামূলক সি সি ক্যামেরা থাকা চাই। সি সি ক্যামেরা না থাকলে ঐ হিফজখানায় আপনার আদরের সন্তানদের ভর্তি করাবেন না। পাশাপাশি, যারা তাদের সন্তানদের হিফজখানা অথবা কোন মাদ্রাসার ছাত্রাবাসে রেখে পড়াচ্ছেন, তারা শীঘ্রই সন্তানদের সাথে খোলামেলা আলাপ করুন এবং নিশ্চিত হোন যে তারা কোনভাবে শারিরীক, মানসিক অথবা যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছে কিনা।
.
ইসলাম আমাদেরকে কুরআনুল কারীম হিফজ করতে উৎসাহিত করেছে কিন্তু বাধ্যতামূলকভাবে সবাইকে পুরো কুরআনের হাফেজ হতে নির্দেশ করেনি। আর এটা সম্ভবও নয়। যাকে দিয়ে যেটা হবেনা, তাকে দিয়ে জোর করে সেটা করানোর চেষ্টা করা— বোকামি আর সময় নস্ট করা ছাড়া কিছুই নয়।
.
কুরআন সহীহ শুদ্ধ ভাবে পড়তে পারা, নিয়মিত তিলাওয়াত ও কুরআনের মর্মার্থ বুঝাটা হল আবশ্যক। ত্রিশ পারা কুরআনের হাফেজ তো আর সবাই হতে পারবে না। তবে, যাদেরকে আল্লাহ তায়ালা মেধা ও তাওফিক দিয়েছেন তাদের উচিত এই মহারত্নকে হৃদয়ে গেথে রাখার প্রানান্তকর চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া। কারণ এ যে পরম সৌভাগ্যের বিষয় যা সবার নসিবে থাকেনা।
.
ফুলটাইম হিফজের পাশাপাশি এদেশে পার্টটাইম তাহফিজ সেন্টারেরও খুব দরকার। যারা পুরো কুরআন হিফজ করতে পারবে না তারা পাঁচ পারা, দশ পারা কিংবা পনেরো পারা হিফজ করবে। এতে লজ্জার কিছু নেই। আরব বিশ্বে এই সুন্দর প্রচলনটি রয়েছে। অর্থাৎ তারা প্রায় সবাই কুরআনের কিছু না কিছু হিফজ করে থাকে। যাদের মেধা ভালো তারা পুরো কুরআন আর অন্যান্যরা তাদের সাধ্যমত। এটাই বাস্তবতা। এখানে তো জোরাজোরি কিংবা মারামারির কিছু নেই। একজন শিক্ষক তার ছাত্রদেরকে প্রয়োজনে অবশ্যই শাসন করতে পারে। কিন্তু এভাবে পিটিয়ে শরীরে দাগ করে ফেলা, হাতে পায়ে শিকল বেধে রাখা এবং ইচ্ছা বা সাধ্যের বাইরে অভিবাবক কতৃক অনবরত সন্তানদের মাত্রাতিরিক্ত চাপ প্রয়োগ করা— এসবের কোনটাই ইসলাম সম্মত নয়। এতে শিশুর স্বাভাবিক বিকাশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
.
উন্নত দেশগুলোতে, চাইলেই যে কেউ শিক্ষক হতে পারে না। শিক্ষক হতে হলে নূন্যতম একাডেমিক যোগ্যতার পাশাপাশি তাদেরকে কিছু প্রশিক্ষণ নিতে হয়। বিশেষ করে, বদমেজাজী লোক হলে তো শুরুতেই শিশুদের জন্য শিক্ষক বাছাইয়ে সে ডিসকোয়ালিফাইড বলে বিবেচিত হবে। শিশুদেরকে পড়াতে হলে, প্রচন্ড ধৈর্য্যশক্তি এবং যথেস্ট সেন্স অব হিউমর থাকতে হয়। আমাদের দেশেও হিফজ মাদ্রাসার শিক্ষকদের একটি স্বতন্ত্র বোর্ডের আওতায় বাধ্যতামূলক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা রাখা দরকার।
.
মিশরে অধ্যয়নকালে বিশ্ববিখ্যাত প্রশিক্ষক ড. হুসনি আব্দুর রহিম ক্বিনদিলের সুপারভিশনে “আদর্শ পাঠদান পদ্ধতি” এর উপর ৫০ ঘন্টার একটি কোর্স করেছিলাম। সেই কোর্সে তিনি যেকোন পরিস্থিতিতে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের বেত্রাঘাত করতে সর্বাবস্থায় নিষেধ করেছেন। ওনার মতে, ক্লাশে বেত রাখা যাবে কিন্তু ছাত্রদের উপর প্রয়োগ করা যাবে না বরং অন্যান্য উপায়ে তাদেরকে শাসন করতে হবে। আসলে শাসনের যথাযথ পদ্ধতি জানা থাকলে, বেত ব্যবহারের প্রয়োজন পড়েনা।
.
আমাদের দেশে যে কোন উপলক্ষ্যে মাদ্রাসা কিংবা স্কুলগুলোতে বাৎসরিক ছুটি দিলে স্বভাবতই শিক্ষার্থীরা খুব খুশী হয় কিন্তু পৃথিবীতে এমন অনেক দেশ আছে যেখানে স্কুল বন্ধ দিলে শিশুরা কান্না করে। কারণ তারা বাসার চেয়ে স্কুলকে বেশী ইনজয় করে। ছুটির দিনগুলোতে তারা তাদের সুন্দর ক্লাসরুম, ক্লাশমেইট এবং প্রিয় শিক্ষকদের খুব মিস করে।
.
মনে আনন্দ নিয়ে বাচ্চারা যেটা শিখে, সেটাই তারা দীর্ঘদিন মনে রাখতে পারে। আমাদের সোনামণিরা মনের আনন্দে, হেসে, খেলে যেন সব শিখতে পারে, সেটার প্রতি আমাদের সবার লক্ষ্য রাখা উচিত। আনন্দ আর উৎসাহ নিয়ে ওরা যা শিখবে, সেটাই হল আসল শিক্ষা। এতে করে শৈশবের এই মূহুর্তগুলো ওদের জীবনে সুন্দর স্মৃতি হয়ে থাকবে। মানুষ স্বভাবতই তার অতীতকে ফিরে দেখতে ও স্মৃতিচারণ করতে পছন্দ করে। তার শৈশবের সকল নস্টালজিয়া বা অতীতবিধুরতার কল্পনায় আবেগাপ্লুত হয়। কিন্তু এভাবে অমানবিক নির্যাতনের মধ্য দিয়ে যদি কোন শিশু বড় হয়, তাহলে সেটা সে সহজে ভুলতে পারে না। ফলে, এটা তার চিন্তাপ্রক্রিয়া ও বেড়ে ওঠায় মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। যেটার বিরুপ প্রতিক্রিয়া তার পুরো জীবনটাকেই ধ্বংস করে দিতে পারে। নষ্ট করে দিতে পারে তার আগামীর উজ্জ্বল ভবিষ্যত।
তাই, মনে রাখবেন— জোর করে কিছু শেখানোর নাম শিক্ষা নয়, শিক্ষা হল আপনার সন্তানের সত:স্ফুর্ত আত্মবিকাশ।”
0 Response to "জোর করে কিছু শেখানোর নাম শিক্ষা নয়, - মিজানুর রহমান আজহারি"
Post a Comment