আজ শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ৩৮তম শাহাদাতবার্ষিকী । লেফটেন্যান্ট জেনারেল জিয়াউর রহমান (১৯ জানুয়ারি, ১৯৩৬ – ৩০ মে, ১৯৮১) ছিলেন বাংলাদেশের সপ্তম রাষ্ট্রপতি, একজন সেনাপ্রধান এবং একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযুদ্ধের পর জিয়াউর রহমান ১৯৭৭ সালের ২১শে এপ্রিল বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হন এবং ১৯৭৮ সালের ১লা সেপ্টেম্বর তিনি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি চার বছর বাংলাদেশ শাসন করার পর ১৯৮১ সালের ৩০শে মে এক ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানে নিহত হন।
জিয়াউর রহমানের সংক্ষিপ্ত জীবনী:
১। জিয়াউর রহমান ১৯৩৬ সালের ১৯শে জানুয়ারি বাংলাদেশের বগুড়া জেলার বাগবাড়ী গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম ছিল মনসুর রহমান এবং মাতার নাম ছিল জাহানারা খাতুন ওরফে রানী। পাঁচ ভাইদের মধ্যে জিয়াউর রহমান ছিলেন দ্বিতীয়।
২। তাঁর শৈশবের কিছুকাল বগুড়ার গ্রামে ও কিছুকাল কলকাতা শহরে অতিবাহিত হয়। ভারতবর্ষ বিভাগের পর (১৯৪৭) তাঁর জন্মস্থান পূর্ব পাকিস্তানের অংশে চলে আসে এবং তাঁর পিতা মনসুর রহমান পাকিস্তানের পক্ষে অপসন দিয়ে করাচীতে চলে আসেন।
৩। করাচীতে এক মাসের মতো ভাড়া বাসায় থাকার পর জেকব লাইনে তারা বসবাস শুরু করেন। ১৯৪৮ সালের ১ জুলাই কমল ‘করাচী একাডেমী স্কুলে’ সপ্তম শ্রেণীতে ভর্তি হন। ১৯৫২ সালে এই স্কুল থেকেই তিনি ২য় বিভাগে ম্যাট্রিক পাশ করেন। এরপর ভর্তি হন ডি.জে কলেজে। একই বছর তিনি কাকুল মিলিটারি একাডেমীতে অফিসার ক্যাডেট হিসেবে যোগদান করেন।
৪। ১৯৫৩ সালে তিনি কাকুল পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমিতে অফিসার ক্যাডেট হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৫৫ সালে তিনি সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট হিসেবে কমিশন প্রাপ্ত হন। তিনি সেখানে দুই বছর চাকুরি করেন, তারপর ১৯৫৭ সালে ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে বদলি হয়ে আসেন। তিনি ১৯৫৯ থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা বিভাগে কাজ করেন।
৫। ১৯৬০ সালে পূর্ব পাকিস্তানের দিনাজপুর শহরের বালিকা, খালেদা খানমের সঙ্গে জিয়াউর রহমান বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন।
৬। ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে একটি কোম্পানির কমান্ডার হিসেবে খেমকারান সেক্টরে তিনি অসীম বীরত্বের পরিচয় দেন। এই যুদ্ধে বীরত্বের জন্য পাকিস্তান সরকার জিয়াউর রহমানকে হিলাল-ই-জুরাত খেতাবে ভূষিত করে।
৭। ১৯৬৬ সালে তিনি পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমিতে পেশাদার ইনস্ট্রাক্টর পদে নিয়োগ লাভ করেন। সে বছরই তিনি পশ্চিম পাকিস্তানের কোয়েটার স্টাফ কলেজে কমান্ড কোর্সে যোগ দেন। ১৯৬৯ সালে তিনি মেজর পদে উন্নীত হয়ে জয়দেবপুরে সেকেন্ড ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেকেন্ড-ইন-কমান্ড পদের দায়িত্ব লাভ করেন। উচ্চ প্রশিক্ষণের জন্য তিনি পশ্চিম জার্মানিতে যান।
৮। ১৯৭০ সালে একজন মেজর হিসেবে তিনি দেশে ফিরে আসেন এবং চট্টগ্রামে অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেকেন্ড-ইন-কমান্ড পদের দায়িত্ব লাভ করেন।
৯। ১৯৭১ সালের ২৭শে মার্চ তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষ থেকে চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা পত্র পাঠ করেন এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানী বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা করেন। মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বের জন্য বাংলাদেশ সরকার তাঁকে বীর উত্তম খেতাবে ভূষিত করে। জিয়া মুক্তিযুদ্ধে সেক্টর ও ফোর্স অধিনায়ক ছিলেন যার বিরুদ্ধে মুজিবনগর সরকার/ সিইনসি ওসমানী শাস্তিমূ্লক ব্যবস্থা নেয়।
১০। স্বাধীনতার পর জিয়াউর রহমানকে কুমিল্লায় সেনাবাহিনীর ব্রিগেড কমান্ডার নিয়োগ করা হয় এবং ১৯৭২ সালের জুন মাসে তিনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ডেপুটি চিফ-অফ-স্টাফ নিযুক্ত হন। ১৯৭৩ সালের মাঝামাঝি তিনি ব্রিগেডিয়ার পদে এবং বছরের শেষের দিকে মেজর জেনারেল পদে পদোন্নতি লাভ করেন।
১১। ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগষ্ট বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবর রহমানের হত্যা হওয়ার পর, খন্দকার মোশতাক আহমেদ রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তারপরে ঐ বছরের ২৫শে আগষ্ট জিয়াউর রহমান চীফ অফ আর্মী স্টাফ নিযুক্ত হন।
১২। ১৯৭৫ সালের ৩রা নভেম্বর বীর বিক্রম শাফায়াত জামিলের নেতৃত্বাধীন ঢাকা ব্রিগেডের সহায়তায় বীর উত্তম মেজর জেনারেল খালেদ মোশাররফ এক ব্যার্থ সামরিক অভ্যুত্থান ঘটান। এর ফলে ৬ই নভেম্বর খন্দকার মোশতাক আহমেদ পদত্যাগ করতে বাধ্য হন এবং আবু সাদাত সায়েম বাংলাদেশের নতুন রাষ্ট্রপতি হন। এর পর জিয়াউর রহমানকে চীফ-অফ-আর্মি স্টাফ হিসেবে পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হয় এবং গৃহবন্দি করে রাখা হয়।
১৩। বীর উত্তম কর্নেল (অবঃ) আবু তাহের সে সময় চট্টগ্রামে অবস্থান করছিলেন। কর্নেল তাহের ছিলেন জিয়াউর রহমানের একজন বিশেষ শুভাকাঙ্ক্ষী। তিনি সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী ছিলেন। সৈনিক-অফিসার বৈষম্য তার পছন্দ ছিল না। তার এই নীতির জন্য তাহের সেনাবাহিনীর সাধারণ সৈনিকদের মাঝেও দারুন জনপ্রিয় ছিলেন। কর্নেল তাহের বিশ্বাস করতেন জিয়াও তারই আদর্শের লোক। ৩রা নভেম্বরের অভ্যুত্থানের পর তাহের জানতে পারেন জিয়াউর রহমানকে বন্দী করা হয়েছে। তিনি ঢাকাতে তার অনুগত ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সিপাহীদের পাল্টা প্রতিরোধ গড়ার নির্দেশ দিয়ে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা রওনা হন, এ সময় তার সফর সঙ্গী ছিল শত শত জাসদ কর্মী। কর্নেল তাহেরের এই পাল্টা অভ্যুত্থান সফল হয় ৭ই নভেম্বর। কর্নেল তাহের, জিয়াউর রহমানকে ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট থেকে মুক্ত করে নিয়ে আসেন। ঐ দিনই পাল্টা অভ্যুত্থানে ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈন্যরা জেনারেল খালেদ মোশাররফকে হত্যা করে। এরপর জেনারেল জিয়া ক্ষমতায় উঠে আসেন।
১৪। জিয়াউর রহমান রহস্যজনক কারণে কর্নেল (অবঃ) আবু তাহেরের বিরুদ্ধে দেশদ্রোহীতার অভিযোগ আনেন। এতে ১৯৭৬ সালের ২১শে জুলাই কর্নেল তাহেরের ফাঁসি হয়। ধারণা করা হয়, ৭ই নভেম্বর কর্নেল তাহেরের জনপ্রিয়তা দেখে জিয়াউর রহমান শঙ্কিত ছিলেন। তাই ক্ষমতা নিষ্কণ্টক রাখার জন্যই তাহেরের বিরুদ্ধে দেশদ্রোহীতার অভিযোগ আনেন।
১৫। জিয়া দালাল আইন বাতিল করে সাজাপ্রাপ্ত ও বিচারাধীন ১১ হাজার রাজাকার আল-বদরকে বন্দীদশা থেকে মুক্ত করেন। কুখ্যাত রাজাকার গোলাম আযমকে দেশে এনে পুনর্বাসন করেন এবং রাজাকারদের মন্ত্রী-প্রধানমন্ত্রী বানিয়েছেন। ক্ষমতায় বসে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর খুনীদের বিদেশী দূতাবাসে বড় বড় চাকরি দিয়ে পুরস্কৃত করেছেন। হানাদার পাকি-সামরিক জান্তার সহযোগী ঘৃণিত মুসলিম লীগ জামায়াতীদের রাজনীতিতে পুনর্বাসন করেছেন এবং সংবিধানের অসামপ্রদায়িক চরিত্র হনন করে সংবিধানকে ক্ষতবিক্ষত করেছেন।
১৬। ১৯৭৮ সালের ১লা সেপ্টেম্বর জেনারেল জিয়াউর রহমান বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) প্রতিষ্ঠা করেন। বর্তমানে বেগম খালেদা জিয়া এই দলের চেয়ারপারসন।
১৭। জিয়া প্রবর্তিত উন্নয়নের রাজনীতির কতিপয় সাফল্য: সকল দলের অংশগ্রহণের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি ও জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান; জাতীয় সংসদের ক্ষমতা বৃদ্ধি; বিচার বিভাগ ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ফিরিয়ে দেয়া; দেশে কৃষি বিপ্লব, গণশিক্ষা বিপ্লব ও শিল্প উৎপাদনে বিপ্লব; সেচ ব্যবস্থা সম্প্রসারণের লক্ষ্যে স্বেচ্ছাশ্রম ও সরকারী সহায়তার সমন্বয় ঘটিয়ে ১৪০০ খাল খনন ও পুনর্খনন; গণশিক্ষা কার্যক্রম প্রবর্তন করে অতি অল্প সময়ে ৪০ লক্ষ মানুষকে অক্ষরজ্ঞান দান; গ্রামাঞ্চলে শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষায় সহায়তা প্রদান ও গ্রামোন্নয়ন কার্যক্রমে অংশগ্রহণের জন্য গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী (ভিডিপি) গঠন; গ্রামাঞ্চলে চুরি, ডাকাতি, রাহাজানি বন্ধ করা; হাজার হাজার মাইল রাস্তা-ঘাট নির্মাণ; ২৭৫০০ পল্লী চিকিৎসক নিয়োগ করে গ্রামীণ জনগণের চিকিৎসার সুযোগ বৃদ্ধিকরণ; নতুন নতুন শিল্প কলকারখানা স্থাপনের ভেতর দিয়ে অর্থনৈতিক বন্ধ্যাত্ব দূরীকরণ; কলকারখানায় তিন শিফট চালু করে শিল্প উৎপাদন বৃদ্ধি; কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি ও দেশকে খাদ্য রপ্তানীর পর্যায়ে উন্নীতকরণ; যুব উন্নয়ন মন্ত্রাণালয় ও মহিলা বিষয়ক মন্ত্রণালয় সৃষ্টির মাধ্যমে দেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে যুব ও নারী সমাজকে সম্পৃক্তকরণ; ধর্ম মন্ত্রণালয় প্রতিষ্টা করে সকল মানুষের স্ব স্ব ধর্ম পালনের সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধিকরণ; বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় সৃষ্টি করে প্রযুক্তির ক্ষেত্রে অগ্রগতি সাধন; তৃণমূল পর্যায়ে গ্রামের জনগণকে স্থানীয় প্রশাসন ব্যবস্থা ও উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত করণ এবং সর্বনিম্ন পর্যায় থেকে দেশ গড়ার কাজে নেতৃত্ব সৃষ্টি করার লক্ষ্যে গ্রাম সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন; জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে নির্বাচনের মাধ্যমে বাংলাদেশের আসনলাভ; তিন সদস্যবিশিষ্ট আল-কুদস কমিটিতে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তি; দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলে 'সার্ক' প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগ গ্রহণ; বেসরকারিখাত ও উদ্যোগকে উৎসাহিতকরণ; জনশক্তি রপ্তানি, তৈরি পোশাক, হিমায়িত খাদ্য, হস্তশিল্পসহ সকল অপ্রচলিত পণ্যোর রপ্তানীর দ্বার উন্মোচন; শিল্পখাতে বেসরকারি বিনিয়োগের পরিমাণ বৃদ্ধি ও বিনিয়োগ ক্ষেত্রের সম্প্রসারণ।
১৮। জিয়ার সময়ে দুর্ণীতি হয়েছে অনেক, কিন্তু তার পক্ষে সেগুলোর বিচার করা সম্ভব হয়নি।
১৯। জিয়া তার দলের স্থানীয় কর্মকর্তাদের মধ্যে এক ঘঠিত কলহ থামানোর জন্য ১৯৮১ সালের ২৯শে মে চট্টগ্রামে আসেন এবং সেখানে চট্টগ্রামের সার্কিট হাউসে থাকেন। তারপর ৩০শে মে গভীর রাতে সার্কিট হাউসে বীর উত্তম মেজর জেনারেল আবুল মঞ্জুরের নেতৃত্বে এক ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানে জিয়া নিহত হন। জিয়াউর রহমানকে ঢাকার শেরে বাংলা নগরে দাফন করা হয়।
২০। বাংলাদেশের অন্যতম দুর্ণীতিবাজ তারেক রহমান হচ্ছেন শহীদ জিয়ার বংশধর, আমাদের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ বিএনপি নেতা।
সূত্রঃ জিয়াউর রহমান - উইকিপিডিয়া
0 Response to "শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সংক্ষিপ্ত জীবনী"
Post a Comment