কিশোর কাজি (আরব্য উপন্যাস অবলম্বনে)

খলিফা হারুন-অর-রশীদের শাসনকালে বাগদাদে আলী কোজাই নামে এক বণিক বাস করত। সারা জীবন পরিশ্রম করে সে অনেক টাকা সঞ্চয় করেছিল। তারপর একবার কয়েকজন প্রতিবেশী মক্কায় হজ করতে যাবে শুনে তারও মক্কা যাবার খুব ইচ্ছে হলাে। কিন্তু সঞ্চিত অর্থগুলাে কোথায় নিরাপদ আশ্রয়ে রাখবে সে নিয়ে
হলাে সমস্যা। প্রতিবেশীদের কেউ কেউ বলল, অর্থগুলাে খলিফার নিকট রেখে যাও। আবার কেউ বলল, কোনাে বিশ্বস্ত বন্ধুর কাছে রেখে গেলেই হয়। এসব শুনে অনেক চিন্তাভাবনা করে আলী একটি বড় কলসি কিনল। মক্কায় যাবার খরচ বাদে বাকি সমস্ত অর্থ কলসিতে ব্লেখে সেটা জলপাই দিয়ে পূর্ণ করল। তারপর পাশের বাড়িতে বিশ্বস্ত বন্ধু নাজিমের নিকট গিয়ে কলসিটি আমানত রেখে এল এবং বলল, তুমি যদি আমার জলপাইয়ের কলসি রাখাে খুবই উপকার হবে। আমি কিছুদিনের জন্য মক্কায় যাচ্ছি। নাজিম বলল, এ সামান্য বিষয় নিয়ে ভাববার কী আছে। তুমি কলসিটি এখানে রেখে নিশ্চিন্ত মনে মক্কা শরিফ যেতে পারাে। এই বলে খুশিমনেই বন্ধু নাজিম আলীকে নিশ্চিন্ত করে বিদায় দিল। আলী অন্যদের সাথে মক্কায় রওনা হলাে। প্রায় দুবছর চলে গেছে এখনও আলী ফিরে আসেনি। একদিন নাজিমের স্ত্রী ও নাজিম খেতে বসেছে। প্রসঙ্গক্রমে তার স্ত্রী বলল, তার খুব জলপাই খেতে ইচ্ছে করছে। এখানে কোথাও জলপাই পাওয়া যাবে কি?
 নাজিম বলল, কেন, আমাদের ঘরেই তাে জলপাই আছে। সেই যে কধু আলী এক কলসি জলপাই রেখে গেছে তা থেকে কয়েকটা নিলেই তাে হয়।
শ্রী বাধা দিয়ে বলল, কী দরকার পরের আমানতের জিনিসে হাত দেওয়ার? তুমি বরং বাজার থেকেই কিনে আনাে। নাজিম বলল, দুবছর হলাে আলী গেছে। এখনও তার কোনাে খোঁজ পাওয়া যায়নি। জীবিত আছে কী না কে জানে? এগুলাে খরচ করে নতুন জলপাই এনে না হয় কলসিটি ভরে রাখলেই হবে। একথা শুনে স্ত্রী আর অমত করল না । নাজিম তখন ভাড়ার ঘরে প্রবেশ করল এবং কলসির মুখ খুলে দেখল। সবগুলাে জলপাই পচে গেছে। নিচে ভালাে থাকতে পাত্রে তেবে সে কলসিটি উপুড় করে ঢেলে দিল। কিন্তু এ ঝ। জলপাই কোথায়? এ যে রাশি রাশি সােনার মােহর। নাজিম খুশিমনে সমত মােহর ঢেলে তার সিন্দুকে তুলে রেখে দিল। তারপর বাজার থেকে এক ঝুড়ি টাটকা জলপাই কিনে নিয়ে কলসিতে ভরে রাখল। কদিন পর আলী মক্কা থেকে ফিরে এল এবং শুর বাড়ি গেল। কধুর বাড়িতে খাওয়ার শেষে কর নিকট থেকে কলসিটি চেয়ে বাড়ি নিয়ে চলে গেল। বাড়ি গিয়ে আলী দেখল কলসিতে একটি মােহল্পও নেই, উপর। থেকে নিচ পর্যন্ত শুধু টটিকা জলপাইয়ে ভর্তি। বিষন্ন মনে আলী আবার নাজিমের কাছে গিয়ে মােহরপুলাে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য অনুরােধ করল। নাজিম বিয়ের ভান করে বলল, সে ঝ কম্পু! তুমি আমার কাছে জলপাই রেখে গেলে। এখন মোহর চাচ্ছ, ব্যাপার কী? আলী তখন কধুর নিকট পুত্রো ঘটনা খুলে বলল এবং মােগুলাে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য বারবার তাকে অনুরােধ করুল। কিন্তু কিছুতেই কিছু হলাে না। বহু অনুনয় করা সত্ত্বেও মােহল্পগুলাে ফিরিয়ে দিতে নাজিম রাজি হলাে
। অগত্যা আলী কাজির দরবারে গিয়ে নালিশ জানাল। কারি ভাবে নাজিম বিচারালয়ে হাজির হলাে। কাজি প্রশ্ন করলেন, তুমি আলীর গচ্ছিত কলসিটি ফিরিয়ে দিলে, ওর ভিতরের মােহরগুলাে দিচ্ছ না কেন? নাজিম বলল, হুজুর ও আমার কাছে এক কলসি জলপাই গচ্ছিত রেখেছিল, তা তাে পেয়েছেই। আমি তাে কলসির মুখ খুলিনি, করে জানব ওতে কী ছিল। কাজি বলল, আলী, তুমি যদি প্রমাণ দিতে পারাে যে, তােমার কলসিতে জলপাইয়ের নিচে মােহর রেখেছিলে, তবে অবশ্যই তা পাবে। কিন্তু আলী কীভাবে প্রমাণ করবে যে, তার কলসির ভিতর জলপাইয়ের নিচে মােহর রেখেছিল। তা তাে আর কেউ জানে না। কাজেই হতাশ হয়ে ফিরতে হলাে। কিছুদিনের মধ্যে সারা বাগদাদে এ ঘটনার কথা ছড়িয়ে পড়ল। একদিন খলিফা হারুন-অর-রশীদ নিজ অভ্যাসমতে উজিত্রের সাথে বেড়াতে বের হয়েছিলেন। সেদিন ছিল। পূর্ণিমা রাত। জোছনার আলােয় চারদিক আলােকিত হয়ে উঠেছিল। খলিফা ঘুরতে ঘুরতে দেখলেন একস্থানে কতকগুলাে বালক চাদের আলােয় বসে খেলা করছে। কৌতূহলী খলিফা সেখানে দাড়ালেন। বালকের মধ্যে একজন বলল, ভাই, চলাে আজ আমরা আলী ও নাজিমের বিচার খেলি। তখন তাদের মধ্যে। একজন আলী ও একজন নাজিম সাজ্জল। একজন আলী সেজে একটি ভাঙা কলসিতে কতকগুলাে মাটির ঢেলাপূর্ণ। জলপাইয়ের কলসি তৈরি করল। কিচার আরম্ভ হলে আলী নালিশ করল। কাজি নাজিমকে হাজির করে জিজ্ঞেস করল​, আলী যা বলেছে তা কি সত্য? নাজিম বলল, হুজর জলপাইয়ের কথা সত্য, তবে মােহন্ত্রের কথা মিথ্যা। কাজি বলল, আচ্ছা কদিন আগে কলসিটি দিয়েছিলে? নাজিম ব​লল, তা প্রায় দুই বছর হবে। কাজি বলল, বেশ, তখন কলসিতে কি এই জলপাই ছিল? নাজ্জিম কলল, হ্যা হুজুর ছিল। কিন্তু আমি তা খুঁইনি। কাজি তখন একজন বালককে লল, যাও তাে একজন জলপাই ব্যবসায়ী ডেকে নিয়ে এসাে। তখন একচ্ছন বালক অলপাই ব্যবসায়ী সেজে কাজির সামনে এসে দাঁড়াল। কাজি বলল, 'আচ্ছা জলপাই কত দিন পর্যন্ত ভালাে থাকে বলাে তাে? ব্যবসায়ী বলল, যত্নে রাখলে বড়জোর ছয় মাস টাটকা থাকে। কাজি তখন সেই কলসিটি দেখিয়ে বলল, এই জলপাইগুলাে দ্যাখাে তাে কত দিনের ? ব্যবসায়ী পরীক্ষার ভান করে বলল, হুজুর, বেশি হলে এক মাস আগে এগুলো গাছ থেকে পাড়া হয়েছে। কাজি তখন নাজিমকে বলল, সব তাে শুনলে। তুমি ভীষণ মিথ্যাবাদী। নিশ্চয়ই তুমি কলসির ভিতরের মােহরগুলাে নিয়ে নতুন জলপাই দিয়ে কলসিটি ভর্তি করে রেখেছিলে। অতএব এখনই আলীর মােহরগুলাে ফিরিয়ে দাও। অন্যথায় তােমায় বন্দি করব। নাজিম হন সব স্বীকার করে আলীর মােহরগুলাে ফিরিয়ে দিল। বালকের কিারক্ষমতা দেখে খলিফা ও উজির বিমিত হলেন এবং বালকদের অনেক পুরস্কার দিলেন। খলিফা বালকদের বললেন, বালকেরা তোমরা আগামী দিন আমার বিচারালয়ে গিয়ে আলী ও নাজিমের বিচারটি করবে
। বালকেরা আনন্দিত মনে রাজি হলাে। পরদিন সকালে বালকদের বিচার দেখতে বিচারালয়ে অনেক মানুষের ভিড় হলাে। খলিফা আলী ও নাজিমকে তাঁর দরবারে ডাকলেন এবং সেই বালকদেরও নিয়ে এলেন। যথা নিয়মে সে বালক কাজির আসনে বসে কিার করতে অরন্তু করল। গত রাতের মতােই সে সঠিকভাবে বিচার করে নামিকে দোষী সাব্যস্ত করল। তথন নাজিম বাধ্য হয়ে তার সকল অপরাধ স্বীকার করল এবং আলীর মােহরগুলাে ফিরিয়ে দিল। দরবারসুদ্ধ সৰ মানুষ তখন সেই বালকদের​ প্রশংসা করতে লাল। খলিফা তখন খুশি হয়ে সেই বালকের শিক্ষার দায়িত্ব নিলেন এবং বড় হলে তাকে কাজির পদ প্রদান করে। পুরস্কৃত করলেন।

Share This

0 Response to "কিশোর কাজি (আরব্য উপন্যাস অবলম্বনে)"

Post a Comment

AD